বিস্তারিত আরো পড়ুন

মেধাসম্পদ রক্ষা ও কপিরাইট সচেতনতায় আমাদের করণীয় (পর্ব-১)

ব্লগ  |  মিডিয়া  |  ফাহিম ফয়সাল

২০২২-১২-০৬ ০১:২২

মেধাসম্পদ রক্ষা ও কপিরাইট সচেতনতায় আমাদের করণীয় (পর্ব-১)

ফাহিম ফয়সালঃ সৃজনশীল অঙ্গনের মানুষ মাত্রই খেয়ালী প্রকৃতির। তারা কখন যে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায় তা তারা নিজেরাও জানে না। অবচেতন মনে ভাবতে থাকে নিজের সৃজনশীলকর্ম নিয়ে। একই আড্ডা বা সভায় অনেক মানুষ থাকলেও এই খেয়ালী প্রকৃতির মানুষগুলো চাইলে নিজের মনকে সবার থেকে আলাদা কোন এক জগতে নিয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই। যাকে আমরা বলি 'ক্রিয়েটিভ জোন'। যেখানেই থাকুক না কেন, যে অবস্থাতেই থাকুক নিজের সৃজনশীল কর্মটির জন্য নিজেকে আলাদা করে ফেলা তাদের কাছে সময়ের ব্যাপার।

সৃজনশীল মানুষেরা সবসময় বসবাস করে স্বপ্নের জগতে। কিন্তু যারাই স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন করার জন্য যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে তারাই এক সময় না এক সময় জয়ী হয়। এই বিষয়ে বিশ্বখ্যাত জার্মান কবি ও দার্শনিক জোহান গথে বলেছেন, “যদি কাল কিছু অর্জন করতে চাও, তবে আজ থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করো”। স্বপ্ন নিয়ে বৃটিশ কেমিস্ট ও লেখক ডগলাস এভ্রিট বলেছেন, “কিছু মানুষ স্বপ্নের জগতে বাস করে। কিছু মানুষ বাস্তবে বাস করে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করে”।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। শিরোনামের আলোকে মেধাসম্পদ ও কপিরাইট নিয়ে আমি আলোচনা করবো। প্রথমত জেনে নেই, মেধাসম্পদ কি? সৃজনশীল ব্যক্তি তার মেধা প্রয়োগ করে যা কিছু সৃজন করেন তাই হচ্ছে মেধাসম্পদ। এবার জেনে নেই সৃজনশীল অঙ্গনের কোন কোন কাজগুলোকে সারাবিশ্বে 'মেধাসম্পদ' হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয় বা বিবেচনা করা হয়।

মেধাসম্পদের মধ্যে রয়েছে- সংগীতকর্ম, নাট্যকর্ম, রেকর্ডকর্ম, চলচ্চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম, অনুবাদকর্ম, গবেষণাতত্ত্ব, শিল্পকর্ম, প্রচ্ছদকর্ম, কার্টুন, অ্যানিমেশন, বিজ্ঞাপন (ভিডিও, অডিও, পোস্টার, বিলবোর্ড সহ অন্যান্য), বাংলা ডাবিংকৃত (বিদেশি চলচ্চিত্র, নাটক, কার্টুন, অ্যানিমেশন), স্লোগান, থিম সং, ফটোগ্রাফ, স্থাপত্য নকশা, চার্ট, স্কেচ, ভাস্কর্য, পেইন্টিং, অনুবাদকর্ম, বেতার সম্প্রচার, টেলিভিশন সম্প্রচার, কম্পিউটার-সফটওয়্যারকর্ম, কম্পিউটার গেইম, ডাটাবেইজ, মোবাইল অ্যাপস, গণমাধ্যম (পত্রিকা/অনলাইন পোর্টাল), ই-মেইল, ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, স্ট্রিমিং বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন ধরনের মৌলিক শিল্পকর্ম এবং লোক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ইত্যাদি।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই মেধাসম্পদ। চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে বিশ্বে যত প্রকারের ব্যবসা রয়েছে, তার মোট লভ্যাংশের ৫০% এরও অধিক লভ্যাংশ আসে এই মেধাসম্পদ থেকেই। তাইতো পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের মেধাসম্পদকে কাজে লাগিয়ে আজ নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্বকে। কারণ, তারা মেধাসম্পদের মূল্য বুঝে। রাষ্ট্রিয়ভাবে এই মেধাসম্পদের বিকাশ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাদের দেশে গবেষণা হয়। তাইতো উন্নত দেশগুলোতে সৃজনশীল অঙ্গনের মানুষদের কদর আকাশচুম্বি।

আধুনিক বিশ্ব এখন অনেক এগিয়ে গেলেও আমরা রয়েছি বেশ পিছিয়ে। এর কারণ, কি? কেনই বা আমরা এতো পিছিয়ে? কেনই বা আমরা এখনও নিজেদের মেধাসম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না? এর মূল কারণই হচ্ছে গবেষণা না করা, না জানা এবং সচেতনতার অভাব। একজন মানুষ বা একটি জাতিগোষ্ঠী কখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে? যখন সে বা তারা নিজেকে বুঝতে পারে, নিজের মেধা ও যোগ্যতা সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা লাভ করতে পারে ঠিক তখন।

অনেকেই হয়তো দ্বিমত পোষন করে বলবেন, আমরা এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছি। আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুগল, ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহার করছি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করছি। এসবের মাধ্যমে অনেক কিছুইতো জানতে পারছি, শিখতে পারছি। তাহলে আমরা কোন দিক দিয়ে পিছিয়ে? প্রশ্নটি অবশ্যই যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে এতো কিছু জানছি তা কি আমাদের মেধাসম্পদের প্রসার ও রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কাজে লাগছে? আমার সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে- 'কাজে লাগছে না'। কারণ, সৃজনশীল অঙ্গনের মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই এই বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না বললেই চলে বা সচেতন নন।

আমার এই আলোচনায় আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, উন্নত বিশ্বের কাতারে সামিল হতে গেলে উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেয়া কি আসলেই জরুরী? উত্তর হবে, 'হ্যাঁ'। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যটি জানার পর আপনারাও আমার সাথে একমত হবেন। বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনীর তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে ৯ জনই হচ্ছেন মেধাসম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ি। তাদের কোম্পানিগুলো হচ্ছে- অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, ওরাকল কর্পোরেশন, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্র্যকশায়ার হ্যাথওয়ে এবং গুগল। এই ৭টি কোম্পানি সরাসরি মেধাসম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। তারা তাদের মেধাসম্পদের প্রসারের পাশাপাশি তার রক্ষণাবেক্ষণেও বেশ সচেতন। তাদের মেধাসম্পদের প্রসারের কারণেই তারা ব্যবসা করে শীর্ষ ধনীর তালিকায় চলে এসেছে। আর মেধাসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি হচ্ছে কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব। এই কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত হলেও অধিকাংশই এর বাস্তবায়ন, প্রয়োগ বা এর সুবিধার বিষয়ে জানি না। 
এবার আলোচনা করব উল্লেখিত মেধাসম্পদগুলো প্রসারের পাশাপাশি এর কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব রক্ষণাবেক্ষণের বিষয় নিয়ে। 
(চলবে......)

©️ফাহিম ফয়সাল

সংগীতশিল্পী, সংগীতপরিচালক, কপিরাইট গবেষক-বিশ্লেষক-পরামর্শক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। 
 

লেখাটি অক্টোবর ৪, ২০২০ এ শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, গবেষণা ও আত্মউন্নয়নমূলক ফেসবুক গ্রুপ সেন্টার ফর ফ্লোরিসে প্রকাশিত হয়।  
fahimfaisalinfo@gmail.com